বাংলাদেশের ফুটবল (প্রবন্ধ)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি - প্রবন্ধ | NCTB BOOK
5.3k
Summary

বাংলাদেশের ফুটবলভূমিকা: ফুটবল বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় খেলা, যা দেশের গ্রাম ও শহরে ব্যাপকভাবে খেলা হয়। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং ব্যক্তি পর্যায়ে পছন্দের দলের জার্সি পরে অনুষ্ঠান পালন করে।

আধুনিক ফুটবলের ইতিহাস: আধুনিক ফুটবল ১৮৬৩ সাল থেকে শুরু হয় এবং ইংল্যান্ডে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ফুটবলকে 'এসোসিয়েশন ফুটবল' বলা হয়, যাকে আমেরিকায় 'সকার' বলা হয়। বাংলাদেশের ফুটবল এসোসিয়েশন ফুটবলের প্রতীক।

বাংলাদেশে ফুটবলের যাত্রা: ব্রিটিশদের মাধ্যমে উপমহাদেশে ফুটবল আসে এবং ১৯ শতকের শেষভাগ থেকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ঢাকা লিগ ফুটবলের মূল আকর্ষণ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় 'স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল' গঠিত হয়।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন: ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাফুফে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন এবং জাতীয় দল নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, এবং ফেডারেশন কাপ মূল টুর্নামেন্ট।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ফুটবল: ১৯৭৩ সালে জাতীয় দল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ প্রথম সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় ও ২০১৯ সালে সাফ গোল্ডকাপে জয়ী হয়।

বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ফুটবল দল: মহিলা ফুটবল কমিটি পরিচালিত হয় এবং ২০১০ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে। জাতীয় দলের কিছু সাফল্য রয়েছে, বিশেষ করে বয়সভিত্তিক নারী ফুটবল দলের মধ্যে।

ফুটবল খেলার মাঠ: বাংলাদেশে কিছু উন্নত মানের ফুটবল মাঠ রয়েছে, যেমন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও অন্যান্য জেলা স্টেডিয়াম।

উপসংহার: ফুটবল বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা হলেও বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলে আন্তর্জাতিক সাফল্য কম। ঘরোয়া ফুটবলের আবেদন হারাচ্ছে, যা পুনরুদ্ধার করতে কার্যকর প্রশিক্ষণ ও নীতিমালা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ফুটবল

ভূমিকা: ফুটবল বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় খেলা। কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের গ্রামে, গঞ্জে, শহরে সর্বত্র ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। এর প্রতি মানুষের আগ্রহের মাত্রা বোঝা যায় বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হলে। তখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত দেশগুলোর পতাকা উড়তে দেখা যায়। অনেকের গায়ে দেখা যায় পছন্দের দলের জার্সি। ফুটবলের প্রতি এ দেশের মানুষের ভালোবাসা ক্রমে এই খেলার প্রতি তাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে তুলছে।

আধুনিক ফুটবলের ইতিহাস: প্রতি দলে এগারো জন করে দুটি দলে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলতে হয়। একটি বায়ুপূর্ণ চামড়ার বলকে হাত ও বাহু ছাড়া শরীরের যে-কোনো অংশ দিয়ে প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের মধ্যে প্রবেশ করাতে হয়। পৃথিবীতে ফুটবল ধরনের বেশ কয়েকটি খেলা প্রচলিত আছে। যেমন, রাগবি অনেকটা ফুটবল খেলার মতো। তবে এখন ফুটবলের যে রূপটি দেখা যায়, তা ১৮৬৩ সালে প্রবর্তিত। মূলত এ সময়ে ইংল্যান্ডে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় এবং তারা ফুটবল খেলার কতগুলো নিয়ম জারি করে। এই নতুন নিয়মের ফুটবল খেলা দ্রুত অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য ইংল্যান্ডকে আধুনিক ফুটবলের জনক বলা হয়। ইংল্যান্ডের ফুটবল এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রবর্তিত হওয়ায় ফুটবলের আরেক নাম 'এসোসিয়েশন ফুটবল'। আমেরিকায় একে বলা হয় 'সসার' বা 'সকার'। এটিকে এসোসিয়েশন শব্দের বিকৃত রূপ বলে মনে করা হয়। রাগবি ফুটবল কেবল রাগবি নামে অধিক পরিচত হওয়ায় এসোসিয়েশন ফুটবল শুধু 'ফুটবল' নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলাদেশে ফুটবল বলতে এসোসিয়েশন ফুটবলকেই বোঝায়।

ফুটবল বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ২১শে মে প্যারিসে গঠিত হয় ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ফিফা)। সংস্থাটি প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম বিশ্বকাপ আসরে শিরোপা অর্জন করে উরুগুয়ে। বর্তমানে ফিফার সদস্য সংখ্যা ২১১।

বাংলাদেশে ফুটবলের যাত্রা: ভারতীয় উপমহাদেশে ফুটবলের আগমন হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। ইংরেজ বণিক, খেলোয়াড় ও সৈনিকরা ফুটবল খেলত। মূলত তাদের মাধ্যমেই উপমহাদেশে ফুটবল খেলা জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশে উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে ফুটবল জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৪৮ সাল থেকে সমগ্র পাকিস্তানে ফুটবলের মূল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায় 'ঢাকা লিগ'। ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ারি ক্লাব, আবাহনী ক্রীড়াচক্র, শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র প্রভৃতি ক্লাব বাংলাদেশে লিগ খেলাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশে ফুটবল একটি নতুন মাত্রায় আবির্ভূত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বিশ্বকে অবগত করতে তখন গঠিত হয়েছিল 'স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল'। তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ১৬টি ম্যাচ খেলেছিল।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালে ঢাকায় ফুটবল লিগ শুরু করে। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু হয় জাতীয় ফুটবল। এক বছর পর থেকেই অর্থাৎ ১৯৭৪ সাল থেকে যুব ফুটবল যাত্রা শুরু করে। ফেডারেশন কাপ শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে নিম্নোক্ত ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলো চালু রয়েছে:

১. বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ: এটি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কর্তৃক আয়োজিত একটি টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ শুরু হয় ২০০৭ সালে। 

২. বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ: এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্রেণির ফুটবল লিগ। ২০১২ সালে এটি যাত্রা করে। 

৩. ফেডারেশন কাপ: এটি বাংলাদেশের প্রিমিয়ার নকআউট প্রতিযোগিতা। ১৯৮০ সাল থেকে এটি আয়োজিত হয়।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন: বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন, খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যা, জাতীয় দল গঠন ও নিয়ন্ত্রণ তথা ফুটবলের যাবতীয় উন্নয়নে কাজ করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। বাফুফে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দল ও বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ফুটবল দলকে তত্ত্বাবধান করে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ফুটবল: বাফুফে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে এএফসি (এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন), ১৯৭৬ সালে ফিফা (ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনালে ডি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) ও ১৯৯৭ সালে সাফ (সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন) বাংলাদেশকে সদস্য করে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল ১৯৭৩ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৮০ সালে 'এএফসি এশিয়া কাপ' টুর্নামেন্টে এবং ১৯৮৬ সালে ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অংশ নেয়। ফুটবলে বাংলাদেশের গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয় ২০০৩ সালে। ওই বছরই বাংলাদেশ প্রথম সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়া ২০১৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন গোল্ডকাপ-এ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ফুটবল দল: বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল কমিটি। বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ফুটবল দল এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের সদস্য। ২০১০ সালের ২৯শে জানুয়ারি দলটি সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন গেমস-এ নেপালের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে। বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ফুটবল দল ২০১০ সালের সাফ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে কক্সবাজারে ভুটানের বিপক্ষে ৯-০ ব্যবধানে এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে জয়লাভ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক নারী ফুটবল দল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেয়েরা বড়ো ভূমিকা রাখছে। তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মেয়েরা।

ফুটবল খেলার মাঠ: স্থানীয় মাঠ ছাড়াও বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি উন্নত মানের ফুটবল মাঠ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও বীর শ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম, চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, সিলেট জেলা স্টেডিয়াম, যশোরের শামসুল হুদা স্টেডিয়াম, রাজশাহী জেলা স্টেডিয়াম, শহিদ কামারুজ্জামান স্টেডিয়াম, গোপালগঞ্জের শেখ ফজলুল হক মনি স্টেডিয়াম, ফেনীর শহিদ সালাম স্টেডিয়াম, ময়মনসিংহ জেলার ময়মনসিংহ স্টেডিয়াম উল্লেখযোগ্য।

উপসংহার: ফুটবল বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেও ফুটবলের জনপ্রিয়তা কম নয়। তবে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য জাতীয় ফুটবল দল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য নিয়ে আসতে পারেনি। এক সময়ে ঘরোয়া ফুটবল সারা বাংলাদেশে যে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করতে পারতো, তাও এখন আবেদন হারিয়েছে। বয়সভিত্তিক ফুটবল দলগুলো মাঝে মাঝে যে সাফল্য দেখাচ্ছে, তা আবার হারিয়ে যাচ্ছে। ফুটবলে গৌরব ফিরিয়ে আনতে দরকার কার্যকর নীতিমালা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায়ও সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ের সন্ধান অব্যাহত রাখা উচিত।

Content added By
Promotion
NEW SATT AI এখন আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

Are you sure to start over?

Loading...